জামদানি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। ইউনেসকোর স্বীকৃতিও মিলেছে। সেই জামদানির সব তথ্য নিয়ে বই লিখেছেন ফ্যাশন ডিজাইনার ফারহানা আফরোজের ‘জামদানি’। বাংলাদেশের বিশ্বনন্দিত ঐতিহ্য শীর্ষক সচিত্র গবেষণা গ্রন্থ। ২১শে বইমেলায় গ্রন্থটি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘জামদানি’ বইটি প্রকাশ করেছে শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ।
গতকাল সোমবার রাতে তারুণ্যের বাংলা’র একান্ত এক সাক্ষাৎকারে বইটির লেখক ফ্যাশন ডিজাইনার ফারহানা আফরোজ ফেন্সী এসব কথা জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে ফেন্সী বলেন, জামদানি শিল্প নগরী একটি অসম্পূর্ণ স্বপ্নের গল্প, প্রতিষ্ঠার দুই দশক পরর নানা সমস্যায় জর্জরিত অবস্থায় আছে জামদানি শিল্প নগরী। এ শিল্প নগরী নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল, তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি এটি বলে মন্তব্য করেছেন ফ্যাশন ডিজাইনার ও লেখক ফারহান আফরোজ ফেন্সী।
ফারহানা আফরোজ দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় জামদানি নিয়ে কাজ ও গবেষণা করে যাচ্ছেন। জামদানি বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে তিনি এই বইটি রচনা করেছেন। বইটিতে জামদানিশিল্পের আদি ইতিহাস, ঐতিহ্য, বর্তমান অবস্থার সন্নিবেশ ঘটেছে।
ফারহানা পেশায় একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। চট্রগ্রাম বিভাগের নোয়াখালী জেলায় জন্ম গ্রহন করেন। বর্তমানে তিনি স্বপরিবারে জার্মানে বসবাস করছেন। পাশাপাশি ঐতিহ্যের জামদানি শিল্পের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ২০০২-২০০৮ ইং পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলায় থাকতেন তিনি। পরে ঢাকা শান্ত মারিয়াম এন্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি থেকে বি.এ অনার্স সম্পন্ন করেন এবং একই বিভেগে জার্মানিতে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি ও তার পরিবার সেখানেই বসবাস করছেন।
তিনি এ বইটিতে জামদানিশিল্পের আদি ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থার পাশাপাশি তাঁতী শ্রমিকদের দুঃখগাথা গল্প এবং তাদের জীবনমানের অবস্থা ফুটিয়ে তুলার চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশের জামদানি নিয়ে যে উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদনের গুণমান ও বিপণন বাড়ানো, বাজারে উচ্চ চাহিদা থাকা নকশা ও নমুনা সরবরাহ করা এবং গুণগত মান উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা। এ ছাড়া, কারিগরদের অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান, উদ্যোক্তা ও তাঁতিদের পুনর্বাসন এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগরদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নও এর লক্ষ্য ছিল।
কিন্তু, বাস্তবে এসবের কিছুই সেখানে ঘটছে না।
শিল্প নগরীটি নির্মাণ করা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) থেকে এসব বিষয়ে কোন নির্দেশিকা, পর্যবেক্ষণ বা আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়নি। গত এক দশকে সেখানে কোনো উন্নয়ন কাজ হয়নি। রাস্তাগুলো জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। একমাত্র পানির পাম্পটিও সম্প্রতি মেরামত করা হয়েছে।
বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত না পেয়ে, ভারতীয় জামদানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে না পেরে এবং মূলধনের অভাবে শিল্প নগরীর উদ্যোক্তারা হয় তাদের প্লট বিক্রি করে দিচ্ছেন অথবা অন্য ব্যবসায় চলে যাচ্ছেন।
২০০২ সালে বিসিক জরিপে আড়াই হাজারের বেশি তাঁতি থাকলেও, সেই সংখ্যা এখন দুই হাজারের নিচে নেমে গেছে। জামদানি তৈরির জন্য তাঁতিদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় এবং বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন হয়। সেই তুলনায় উপযুক্ত মজুরি না পেয়ে তাঁতিরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্মও সেই পথেই হাঁটছে। ফলে, জামদানি শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত।
জামদানির তাঁতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে একজন শিক্ষানবিশ তাঁতির অন্তত ১০ বছর লাগে। এ ছাড়া, জামদানির নকশা আসে সহজাত প্রবৃত্তি থেকে। এসব নকশার কৌশল এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে মৌখিকভাবে যায়।
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জামদানি শিল্প জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ইন্টেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউমিনিটির তালিকায় স্থান পায়। এ ছাড়া, সরকার পাঁচ বছর আগে জামদানিকে একটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। শীতলক্ষ্যার পানির তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মাটি ও খনিজ জামদানি তৈরির জন্য খুবই উপযোগী।
জামদানি শিল্প নগরীর উদ্যোক্তারা ২০২০ সালে প্রায় ৬০ হাজার পিস শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি ইত্যাদি পোশাক থেকে ৩০ থেকে ৩২ কোটি টাকা আয় করেন। যদিও, প্রায় ২০ বছর আগে এসব থেকে বার্ষিক উপার্জন ছিল ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার মতো।
ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটের উদ্যোক্তা ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০ বছরে জামদানি শাড়ির চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
এদিকে জামদানির ওপর তাঁর রচিত বইটির খবর প্রকাশে ইতিমধ্যে বেশ জনপ্রিয় ও পাঠক সমাদৃত হয়েছে।